রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তি | ইতিহাস, কারণ ও ঘটনাবলী

 

প্রাচীন ইতিহাসে রোমান সাম্রাজ্য একটি অদ্বিতীয় নাম। এর রাজনৈতিক শক্তি, সামরিক গৌরব, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বিশ্বকে যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে। তবে এই শক্তিশালী সাম্রাজ্যও বিভক্তি ও পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। “রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তি” একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়, যা শুধু রোম নয়, বরং গোটা ইউরোপীয় সভ্যতার ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তির ইতিহাস, কারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করবো।

রোমান সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

রোমান সাম্রাজ্যের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে, যখন অক্টাভিয়ান (পরবর্তীতে আগুস্তাস সিজার) প্রথম সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যগুলোর একটি। তবে সময়ের সাথে সাথে এর অন্দরে নানা দুর্বলতা ও বিভাজন সৃষ্টি হয়।

রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তির প্রধান কারণসমূহ

কারণ ব্যাখ্যা
প্রশাসনিক জটিলতা বিশাল সাম্রাজ্য একক প্রশাসনে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল ইত্যাদি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে।
অর্থনৈতিক পতন কর আদায়ে দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং কৃষিক্ষেত্রে পতন সাম্রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে।
ধর্মীয় পরিবর্তন খ্রিস্টধর্মের উত্থান এবং প্যাগান ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে।
বিদেশি আক্রমণ গোথ, হুন ও ভ্যান্ডালদের আক্রমণ পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।


বিভক্তির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী

১. ডিওক্লেশিয়ানের প্রশাসনিক সংস্কার (খ্রিস্টাব্দ ২৮৪-৩০৫)

সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান বুঝতে পারেন যে সাম্রাজ্য এককভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তিনি সাম্রাজ্যকে পূর্ব এবং পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক অংশে একজন করে সম্রাট (Augustus) ও একজন সহ-শাসক (Caesar) নিয়োগ করেন। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় "টেট্রার্কি" (Tetrarchy)

২. কনস্টান্টাইন ও কনস্টান্টিনোপল

সম্রাট কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট, খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেন এবং ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টিয়ামে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) নতুন রাজধানী "কনস্টান্টিনোপল" স্থাপন করেন। এর ফলে পূর্ব অংশের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।

৩. ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ী বিভাজন

সম্রাট থিওডোসিয়াস I মৃত্যুর পরে তাঁর দুই পুত্র আর্কেডিয়াস (পূর্বে) এবং হোনোরিয়াস (পশ্চিমে) সাম্রাজ্য ভাগ করে নেন। এটি ছিল রোমান সাম্রাজ্যের স্থায়ী বিভাজন।

৪. ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন

জার্মান যোদ্ধা ওডোয়াসার পশ্চিম রোমান সম্রাট রোমুলাস অগাস্টুলাস-কে পদচ্যুত করে এবং পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে পূর্ব অংশ, অর্থাৎ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, টিকে থাকে আরও হাজার বছর।

বিভক্তির প্রভাব

রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তির ফলে ইউরোপে এক দীর্ঘ অরাজকতা ও "ডার্ক এইজ" এর সূচনা ঘটে। পশ্চিম ইউরোপ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়, যেখানে খ্রিস্টধর্ম এবং ক্যাথলিক চার্চ একমাত্র ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে টিকে থাকে। অপরদিকে, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আরও বহু শতাব্দী টিকে থেকে ধর্ম, শিল্প এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তুলনামূলক চিত্র: পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য

বিষয়ে পার্থক্য পূর্ব রোম পশ্চিম রোম
রাজধানী কনস্টান্টিনোপল রোম
ভাষা গ্রিক ল্যাটিন
ধর্ম খ্রিস্টধর্ম (উচ্চতর সংহত) খ্রিস্টধর্ম (ক্যাথলিক)
অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু
পতনের সময় ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ


উপসংহার

রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তি ছিল এক গভীর ঐতিহাসিক পরিণতি, যা রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে। এই বিভক্তি শুধু একটি সাম্রাজ্যের শেষ ছিল না, বরং একটি নতুন সময়ের সূচনা। আজকের ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক কিছুই এই বিভাজনের দ্বারা প্রভাবিত।

৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: রোমান সাম্রাজ্যকে প্রথম কে ভাগ করেন?
উত্তর: সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান প্রথম প্রশাসনিকভাবে রোমান সাম্রাজ্যকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করেন।

প্রশ্ন ২: রোমান সাম্রাজ্য স্থায়ীভাবে কখন ভাগ হয়?
উত্তর: ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াস I এর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য স্থায়ীভাবে ভাগ হয়ে যায়।

প্রশ্ন ৩: পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য কবে পতিত হয়?
উত্তর: ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে, যখন ওডোয়াসার সম্রাট রোমুলাস অগাস্টুলাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।

প্রশ্ন ৪: পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য কতদিন টিকে ছিল?
উত্তর: পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য (বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।

প্রশ্ন ৫: রোমান সাম্রাজ্যের বিভাজনের প্রধান প্রভাব কী ছিল?
উত্তর: ইউরোপে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, ক্যাথলিক চার্চের শক্তি বৃদ্ধি এবং বাইজান্টাইন সভ্যতার উত্থান।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form